চার ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মন্ত্রী ও এমপিদের আত্মীয়দের প্রার্থী না হওয়ার নির্দেশ দেয় টানা চতুর্থ মেয়াদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা দল আওয়ামী লীগ। এই নির্দেশনা উপেক্ষিত হলেও নিজ দলের প্রার্থীদের চাপে রাখার কৌশল প্রথম ধাপে সফল হচ্ছে বলে মনে করছেন দলের সিনিয়র নেতারা। তারা বলছেন, কৌশল কাজ করায় নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে এখনই স্পষ্ট করে কিছু বলছে না আওয়ামী লীগ। তবে সব ধাপের নির্বাচন শেষ হওয়ার পর এ ব্যাপারে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানা গেছে। সরকারি দলটির প্রথম ও দ্বিতীয় সারির কয়েকজন নেতা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করায় জাতীয় নির্বাচনে দলীয় নেতাদের জন্য প্রার্থিতা উন্মুক্ত রাখার কৌশল নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। সেটি সফল হওয়ায় প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও একই ধরনের কৌশল নেয়া হয়। এই কৌশলের মূলে রয়েছে নির্বাচনের আমেজ সৃষ্টি, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করা এবং সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন। এই কৌশলের অংশ হিসেবে উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না করে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। সেটি করতে তারা পুরোপুরি সফল হয়েছে বলে দাবি দলটির নেতাদের। তারা বলছেন, ৩০০ আসনে জাতীয় নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপির প্রভাব বিস্তারের ঘটনা সেভাবে সামনে আসেনি। কিন্তু দেশের ৪৮০টি উপজেলার এই নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছেন মন্ত্রী-এমপিরা। বিশেষ করে আত্মীয় প্রার্থীদের পক্ষে রাখডাক ছাড়াই মাঠে নেমেছিলেন তারা। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বরাবর একের পর এক উপজেলা থেকে অভিযোগসহ ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ আসতে থাকে। ফলে অনেক উপজেলায় আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ায় নির্বাচনি সহিংসতার আশঙ্কা দেখা দেয়। এমন অবস্থায় নাটোরের সিংড়ায় ডাক, টেলিযোগাযোগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের শ্যালক ও চেয়ারম্যান প্রার্থী লুৎফুল হাবিব রুবেলের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে অপহরণের অভিযোগ ওঠে। কোনও কোনও উপজেলায় ছোটখাটো সংঘাতের খবরও আসে। ফলে মন্ত্রী-এমপি এবং তাদের আত্মীয় প্রার্থীদের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্য তাদের চাপে রাখতে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়া হয় এবং না মানলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলা হয়। এর ফলে প্রথম ধাপের নির্বাচনে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে এবং সুন্দরভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরের ধাপগুলোতেও এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকরা।
এ বিষয়ে কথা হয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর তিন জন, একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও দুই জন সাংগঠনিক সম্পাদকের সঙ্গে। তাদের মতে, উপজেলা নির্বাচনে নির্দেশনা দেয়া হলেও মন্ত্রী-এমপির আত্মীয় প্রার্থীরা তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করবেন না, সেটি মাথায় রেখেই নির্দেশটি দেয়া হয়েছে। এই নির্দেশের সরাসরি প্রভাব পড়েছে নির্বাচনের মাঠে। মন্ত্রী-এমপিরা যেমন নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা থেকে সরে এসেছেন, তাদের আত্মীয় প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরাও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছেন। ফলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যে উদ্দেশ্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তা উপেক্ষিত হলেও কৌশল সফল হচ্ছে বলা যায়। প্রশাসনও অনেকটা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। তারপরও কোথাও সমস্যা তৈরি হলে সাংগঠনিক ও আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ তো রয়েছেই। যেমন নাটোরের ঘটনায় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর ফলে পরের ধাপগুলোর নির্বাচনেও এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। তবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, উপজেলা নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে যাবতীয় সবকিছু করা হয়েছে এবং হচ্ছে। আমরা একটি ভালো নির্বাচন চাই। এবার দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না করায় প্রার্থিতা সবার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। কিন্তু নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করলে, কিংবা কোথাও গণ্ডগোল করলে, অথবা ভালো নির্বাচনের পথে বাধা সৃষ্টি করলে সে যে-ই হোক, তার বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সেই বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে এবং তাতে কাজ হচ্ছে। দলীয় সূত্রমতে, মন্ত্রী-এমপি’র আত্মীয়দের ‘সরে দাঁড়ানোর নির্দেশনা’র পরও অনেক প্রার্থিতা অমান্য করায় তৃণমূলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তবে নির্দেশনার পর থেকে উপজেলা পর্যায় থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রে মন্ত্রী-এমপি ও তাদের আত্মীয় প্রার্থীদের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ আসার সংখ্যা কমেছে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ৩০ এপ্রিল রাতে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে এ নিয়ে কোনও আলোচনা করেননি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। পরে দলটির সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভায়ও এ নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন বলেন, দলের পক্ষ থেকে মন্ত্রী-এমপিদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্বাচনে যাতে তারা আত্মীয় প্রার্থীদের পক্ষে প্রভাব বিস্তার না করেন সেটি নিশ্চিত করার চেষ্টাও করা হয়েছে। নির্দেশনা যারা অমান্য করবেন, দল তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে নির্দেশনার পর নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা অনেকটাই কমেছে। আমরা চাই অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ এবং প্রভাবমুক্ত নির্বাচন। দলীয়ভাবে সেটি নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এখন নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন তাদের দায়িত্ব পালন করবে। আশা করি একটি ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে ১৮ এপ্রিল ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকদের নিয়ে অনানুষ্ঠানিক এক বৈঠক করেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এতে দফতর সম্পাদক ও উপ-দফতর সম্পাদকরাও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ওবায়দুল কাদের সাংগঠনিক সম্পাদক ও দফতর সম্পাদকদের নির্দেশ দেন, উপজেলা নির্বাচনে যেসব মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের আত্মীয়রা প্রার্থী হয়েছেন তাদের তালিকা করতে হবে। ওইসব মন্ত্রী ও এমপিদের দলীয় প্রধানের নির্দেশনা জানিয়ে চিঠি দেয়া এবং তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্যও সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশনা দেন তিনি। সে অনুযায়ী মন্ত্রী-এমপিদের নির্দেশনা সংবলিত চিঠি পাঠানো হয় দফতর থেকে, একইসঙ্গে বিভাগভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকরাও তালিকা ধরে ধরে ফোনে কথা বলেন। কিন্তু তাতেও সাড়া মেলেনি। গতকাল বুধবার অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে প্রথম ধাপের ভোটে অংশ নিয়েছেন এবং অনেকে বিজয়ী হয়েছেন। এরআগে ৫ মে আওয়ামী লীগের সভাপতির ধানমন্ডিতে রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক বিফ্রিংয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের বিরত রাখা আওয়ামী লীগের নীতিগত সিদ্ধান্ত, এখানে আইনি কোনও বিষয় নেই। প্রতীক ছাড়া নির্বাচন করলে নির্বাচন বেশি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে এমন ভাবনা থেকে আওয়ামী লীগ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দ স্থগিত করেছে। পরেরদিন ৬ মে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সম্পাদকমণ্ডলীর এক সভা শেষে বিষয়টি নিয়ে আবারও কথা বলেন ওবায়দুল কাদের। এ সময় উপজেলা নির্বাচনে আত্মীয় প্রার্থীর পক্ষে অনেক সংসদ সদস্য প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের যারাই দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করবে, তাদের সময়মতো কোনও না কোনোভাবে শাস্তি পেতে হবে। মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে সাংগঠনিক কী ব্যবস্থা নেয়া হবে সে বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, সাংগঠনিকভাবে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের আরও সক্রিয়ভাবে কাজ করার কথা বলা হয়েছে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

উপজেলা নির্বাচনে কৌশলে সফল আওয়ামী লীগ
- আপলোড সময় : ০৯-০৫-২০২৪ ০১:২২:০১ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৯-০৫-২০২৪ ০১:২২:০১ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ